মূল্য সংযোজন কর একটি আধুনিক, যুগোপযোগী ও পরোক্ষ কর ব্যবস্থা। এই ব্যবস্থায় নিবন্ধিত ব্যক্তিকে করদাতা হিসেবে গণ্য করা হয়েছে। সাধারণত নিবন্ধিত ব্যক্তি তার পণ্য বা সেবা সরবরাহের সময় ক্রেতার নিকট থেকে বিক্রয় মূল্যের সাথে প্রযোজ্য ভ্যাট আদায় করে থাকেন। আদায়কৃত ভ্যাট ওই নিবন্ধিত ব্যক্তি সরকারের কোষাগারে জমা প্রদান করেন। এর মাধ্যমে ক্রেতাই মূলত ভ্যাট প্রদান করে থাকেন। প্রকৃতপক্ষে এ অর্থেই ক্রেতা বা সর্বশেষ ভোক্তাই হলো ভ্যাটের উৎস। এটাই হচ্ছে ভ্যাটের স্বাভাবিক নিয়ম। স্বাভাবিক ব্যবস্থায় পণ্য বা সেবা যিনি সরবরাহ করেন (নিবন্ধিত ব্যক্তি) তিনি আদায়কৃত ভ্যাট সরকারি কোষাগারে জমা প্রদান করেন। উৎসে মূসক কর্তনের ক্ষেত্রে এ ব্যবস্থাটিকেই উল্টিয়ে দেয়া হয়। উৎসে কর কর্তন পদ্ধতিতে পণ্য বা সেবার ক্রেতা বা ভোক্তা (যিনি ভ্যাটের উৎস) তার প্রদত্ত ভ্যাট সরবরাহকারী ব্যক্তির (নিবন্ধিত ব্যক্তি) পরিবর্তে নিজেই কর্তন করে সরকারি কোষাগারে জমা প্রদান করেন। যখন স্বাভাবিক স্থানে স্বাভাবিক পদ্ধতিতে এবং স্বাভাবিক সময়ে যেসব সেবার ক্ষেত্রে ভ্যাট ফাঁকির ঝুঁকি থাকে বা অন্যান্য কারণে কর আদায় করা সম্ভব হয় না তখন ঐ কর সংক্রান্ত অর্থের যেখানে উৎস সেই জায়গা থেকে পর কর্তন করে নেয়ার বিধানকেই উৎসে কর কর্তন বলা হয়। বাংলাদেশের ভ্যাট ব্যবস্থায় ১৯৯৬ সাল থেকেই সীমিত আকারে উৎসে মূসক কর্তন ব্যবস্থার প্রচলন হয়।
মূসক ও সম্পূরক শুল্ক আইন, ২০১২ এর ধারা ২(২১) অনুসারে উৎসে কর্তনকারী সত্তা হচ্ছেন-
আইনের ধারা ২(৪২) মোতাবেক টার্নওভার অর্থ কোন ব্যক্তির নির্ধারিত সময়ে সর্বমোট করযোগ্য পন্য সরবরাহ বা করযোগ্য সেবা সরবরাহ হতে প্রাপ্ত সকল অর্থ। ধারা ২(৩২) মোতাবেক করযোগ্য সরবরাহ হচ্ছে অব্যাহতিপ্রাপ্ত সরবরাহ ব্যতীত অন্য যেকোনো সরবরাহ। অব্যাহতি প্রাপ্ত সরবরাহ হচ্ছে আইনের প্রথম তফসিলে উল্লেখিত অব্যাহতি প্রাপ্ত এবং মূল অব্যাহতি প্রজ্ঞাপনের (এসআরও) পন্য বা সেবা সমূহের তালিকা।
ব্যবসায়ী যখন কোন উৎসে কর কর্তনকারী ব্যক্তির কাছে সরবরাহ প্রদান করে থাকে তখন উৎসে কর কর্তনকারী কত শতাংশ হারে উৎসে কর্তন করবে তা নিয়ে বেশ সংশয় ও উৎকণ্ঠা রয়েছে। বর্তমানে একজন ব্যবসায়ী (ট্রেডার) আইনের তৃতীয় তফসিলের অনুচ্ছেদ ৩ (তিন) অনুসারে ৭.৫% ভ্যাট প্রয়োগ করে বিক্রয় করে থাকেন। তবে আইনের ধারা ১৫(৩) মোতাবেক একজন ব্যবসায়ী ৭.৫% ভ্যাট হারের পরিবর্তে ১৫% ভ্যাট হারে সরবরাহ করতে পারেন। এখানে আইন নিবন্ধিত ব্যক্তিকে স্বাধীনতা প্রদান করেছে। তিনি যদি ৭.৫% ভ্যাট হার প্রয়োগ করে বিক্রয় করেন তাহলে রেয়াত পাবেন না, অপরদিকে ১৫% ভ্যাট হার প্রয়োগ করে বিক্রয় করলে রেয়াত পাবেন।
যদি কোন ব্যবসায়ী (ট্রেডার) ৭.৫% ভ্যাট হার প্রয়োগ করে উৎসে কর্তনকারী সত্তার নিকট বিক্রয় করে থাকেন তাহলে উৎসে কর্তনকারী সত্তা ১০% হারে উৎসে কর কর্তন করবেন। কিন্তু, ব্যবসায়ী (ট্রেডার) যদি ১৫% ভ্যাট হার প্রয়োগ করে উৎসে কর্তনকারী সত্তার নিকট বিক্রয় করেন এবং সাথে মূসক সম্মাননা পত্র বা সংশ্লিষ্ট বিভাগীয় কর্মকর্তার প্রত্যয়ন পত্র দাখিল করে সেক্ষেত্রে উৎসে কর্তনকারী সত্তা কোন উৎসে কর কর্তন করবেন না।
এসআরও নং-১৮২-আইন/২০২৫/৩১০; তারিখ: ২৭ মে, ২০২৫ উৎসে মূল্য সংযোজন কর কর্তন ও আদায় বিধিমালা, ২০২৫ এর বিধি ৪(২) অনুসারে উৎপাদক হিসেবে নিবন্ধিত ব্যতীত অন্য সকল ব্যক্তি যারা উৎসে কর্তনকারী সত্তার নিকট কোটেশন, দরপত্র, কার্যাদেশ বা অন্যবিধভাবে পণ্য বা সেবা সরবরাহ করেন তারা যোগানদার হিসেবে বিবেচিত হবে। তবে শর্ত থাকে যে, যেই সকল সেবার (এসআরও নং-১৮৬ সেবার সংজ্ঞা) সুনির্দিষ্ট সংজ্ঞা রয়েছে সেই সকল সেবা যোগানদার হিসেবে বিবেচিত হবে না। এই বিধান অনুসারে, উৎসে কর কর্তনকারীর নিকট যেই সরবরাহ প্রদান করুক না কেন শুধুমাত্র উৎপাদনকারী ছাড়া বাকি সবাই যোগানদার হিসেবে বিবেচিত হবে। অর্থাৎ আমদানিকারক এবং ব্যবসায়ী সকলেই যোগানদার হিসেবে বিবেচিত হবে।
বিধিমালার বিধি ৩(১) টেবিল অনুসারে ক্রমিক নং ২২, ঝ০৩৭ যোগানদার (Procurement Provider) হিসেবে ১০% হারে উৎসে মূসক কর্তন করতে হবে। সুতরাং, একজন ব্যবসায়ী উৎসে কর কর্তনকারীর নিকট সরবরাহ প্রদান করলে তাকে যোগানদার হিসেবে বিবেচনায় নিয়ে ১০% হারে উৎসে কর কর্তন করতে হবে।
এক্ষেত্রে ব্যবসায়ী যখন সরবরাহ প্রদান করবেন তখন ৭.৫% হারে মূসক-৬.৩ উৎসে কর কর্তনকারীর নিকট সরবরাহ করবেন এবং ব্যবসায়ী সংশ্লিষ্ট কর মেয়াদেই তার রিটার্নে (মূসক-৯.১) ট্রেজারি চালানের মাধ্যমে এই ভ্যাট সরকারি কোষাগারে জমা প্রদান করবেন। পরবর্তীতে উৎসে কর কর্তনকারী যখন ঐ ব্যবসায়ীর বিল পরিশোধ করবেন তখন বিল থেকে ১০% হারে উৎসে মূসক কর্তন করবেন এবং তার রিটার্নে (মূসক-৯.১) বৃদ্ধিকারী সমন্বয় করার মাধ্যমে সরকারি কোষাগারে জমা করবেন। উৎসে কর কর্তন বিধিমালার বিধি ৬(২)(খ) মোতাবেক উৎসে কর কর্তনকারী সত্তা রিটার্ন (মূসক-৯.১) দাখিল করার ৩ (তিন) কার্য দিবসের মধ্যে ফরম "মূসক-৬.৬" এর মাধ্যমে উৎসে কর কর্তন সনদপত্র ইস্যু করে তার একটি অনুলিপি ঐ ব্যবসায়ীকে (সরবরাহকারীকে) প্রদান করবেন। এবং ব্যবসায়ী ফরম "মূসক-৬.৬" উৎসে কর কর্তন সনদপত্র প্রাপ্তির পরে তার রিটার্নে "মূসক-৯.১" উৎসে কর্তনকৃত (১০%) ভ্যাটের সমপরিমাণ টাকা হ্রাসকারী সমন্বয় গ্রহণ করতে পারবেন। উল্লেখ্য যে, যে কর মেয়াদে "মূসক-৬.৬" প্রত্যয়নপত্র জারি করা হয়, সেই কর মেয়াদ বা সেই কর মেয়াদের পরবর্তী ৬ (ছয়) কর মেয়াদের মধ্যে এই হ্রাসকারী সমন্বয় গ্রহণ করতে হবে এবং এই সময়ের পর উক্ত সমন্বয় দাবি তামাদি হবে।
এই হ্রাসকারী সমন্বয় গ্রহণ করার মাধ্যমে উক্ত ব্যবসায়ীর বিল থেকে যে পরিমাণ ভ্যাট কর্তন করা হয় ঠিক সেই পরিমাণ টাকা তিনি ফেরত পান। উল্লেখ্য যে, এই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে একজন ব্যবসায়ী যখন "মূসক-৬.৩" ইস্যু করেন এবং তা সংশ্লিষ্টকর মেয়াদে তার রিটার্নে (মূসক-৯.১) ট্রেজারি চালানের মাধ্যমে সরকারি কোষাগারে জমা করেন শুধুমাত্র তখন একবারই সরকার রাজস্ব পেয়ে থাকে।